ইন্টারনেটের ব্যবহার শুধু বিনোদনে নয়, বদল হোক উৎপাদনশীলতায়

ছবি সংগৃহীত

 

তানভীর আলী :বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর ৬০ শতাংশ তরুণ, যারা প্রতিনিয়ত নতুন প্রযুক্তির সংস্পর্শে থাকে। তাদের বাইরে শহর থেকে গ্রামে জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশ বর্তমানে ডিজিটালি সংযুক্ত। সবার হাতে স্মার্টফোন রয়েছে। অধিকাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। ফলে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা নিয়ে আমরা এখন গর্ব করতে পারি। তবে আমাদের সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, স্মার্টফোন কিংবা ডিজিটাল ডিভাইসগুলোর মাধ্যমে ইন্টারনেট জগতে বিচরণকে আমরা বিনোদনের প্লাটফর্ম বাদে অন্য কিছু ভাবতে পারি না।

 

প্রায় ৯০ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ‘ইন্টারনেট’ বলতে শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্লাটফর্ম- ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক ইত্যাদি বোঝেন। এটি আমাদের ডিজিটাল ভবিষ্যতের জন্য এক বিপজ্জনক সংকেত। একটি একক বাণিজ্যিক প্ল্যাটফর্মে আমাদের যাবতীয় সামাজিক যোগাযোগ, তথ্যপ্রাপ্তি, এমনকি নাগরিক ভাবনাও বন্দী হয়ে পড়েছে। ইন্টারনেট কিংবা মোবাইলের ব্যবহারকে আমরা আরো প্রোডাক্টিভ করতে পারছি না।

এটা ঠিক সামগ্রিকভাবে দেশের নানা ইস্যু, সরকারের জবাবদিহিতার জায়গা ফেসবুকে তৈরি হয়েছে। নাগরিকরা সহজে মতামত দিতে পারেন। তার পাশাপাশি ফেসবুক-টিকটক প্ল্যাটফর্ম-কেন্দ্রিক বাস্তবতা আমাদের বৃহত্তর ডিজিটাল সম্ভাবনাকে সীমিত করে রেখেছে। নাগরিকদের অনেকেই জানেন না কীভাবে সরকারি ই-সেবা নিতে হয়, কীভাবে গুগলে কার্যকরভাবে তথ্য খোঁজা যায়, বা কীভাবে অনলাইন ব্যাংকিং, ফ্রিল্যান্সিং বা উদ্যোক্তা কার্যক্রমে যুক্ত হওয়া যায়। বস্তুত আমাদের একটি প্রযুক্তিনির্ভর জনগোষ্ঠী গড়ে উঠলেও তারা প্রকৃত অর্থে ডিজিটাল নাগরিক হয়ে উঠতে পারেনি। ফেসবুক, ইউটিউব বা টিকটকের বাইরে ইন্টারনেটের বিশাল দুনিয়া যেন অচেনা ও অধরা থেকে যাচ্ছে।

 

রক্ষণশীল পরিবারগুলোতে মোবাইল ফোনের ব্যবহারকে এখনও নেতিবাচকভাবে দেখা হয়। এটার কারণ হলো- ফোন ব্যবহার করে উৎপাদনশীল কিছু করা যায় এটা আমরা ভাবতে পারি না। আমাদের এই অবস্থানের বদল না ঘটলে প্রযুক্তিতে আগামীর বাংলাদেশের সম্ভাবনা হবে শুধু একটি অ্যাপনির্ভর বাস্তবতা। এখানে ব্যবহারকারীরা জানে শুধু কীভাবে ‘স্ক্রল’ করতে হয়।

 

আমাদের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকেও এটাকে ফ্যাসিলিটেড করা হয়েছে। সিম কোম্পানিগুলো ফেসবুককে জিরো-রেটিং করেছে অর্থাৎ ডেটা ছাড়াই ফেসবুক ব্যবহার করা যায়। এরসঙ্গে ফেসবুকের সহজ ইন্টারফেস ও পরিচিত পরিবেশ কোটি মানুষকে অনলাইন জগতে এনেছে। কিন্তু বাকি ওয়েব জগতকে অদৃশ্য করে ফেলেছি। যদি শিক্ষামূলক, স্কিল সম্পর্কিত ওয়েবসাইটগুলোকে জিরো-রেটেড করা না যায়, তাহলে মানুষ বিনোদনের প্ল্যাটফর্মেই আটকে থাকবে। এতে ইন্টারনেট ব্যবহারের বৈচিত্র্য কমে এবং ডিজিটাল নাগরিকের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।

 

সামাজিক মাধ্যমগুলোতে কন্টেন্ট ক্রিয়েশন, অনলাইনে ব্যবসা, ডেলিভারি সেবা, পাঠদান, আইটি স্কিল এগুলোর প্রচার-প্রসার হচ্ছে। এরফলে ব্যবহারকারীরা বিশেষত কিশোর তরুণ প্রজন্ম শিখতে পারছে। সম্ভাবনাময়ী অনলাইন বিজনেস প্লাটফর্ম দাঁড়িয়েছে। তবে গ্রাহক পর্যায়ে ডিজিটাল লিটারেসির অভাব-যার পরিবর্তন হচ্ছে না। উচ্চমানের কনটেন্ট নেই, স্থানীয় প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মগুলোর সবল উপস্থিতি নেই। ফলে যথাযথ ব্যবহার আমরা নিশ্চিত করতে পারছি না।

 

তবে আমি মনে করি, প্রচুর সম্ভাবনা এখনও রয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ প্রযুক্তি গ্রহণে অত্যন্ত আগ্রহী। গ্রামের কৃষক থেকে শুরু করে শহরের কলেজছাত্রী-স্মার্টফোনের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছেন অনলাইনে। এই প্রবণতা প্রমাণ করে, মানুষ প্রস্তুত। প্রয়োজন শুধু সঠিক দিকনির্দেশনা, সহায়ক অবকাঠামো এবং ভবিষ্যৎমুখী নীতিগত সহায়তা।

 

আমাদের প্রথম কাজ হওয়া উচিত, শুধু ফেসবুক নয়-স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সরকারি সেবা এবং স্থানীয় প্ল্যাটফর্মগুলোতেও জিরো-রেটেড সুবিধা প্রদান করা। মানুষকে দেখাতে হবে, ইন্টারনেট শুধু বিনোদনের জায়গা নয়-এটি হতে পারে জীবনের সমস্যা সমাধানের কার্যকর মাধ্যম।

 

পাশাপাশি, জাতীয় পর্যায়ে একটি ডিজিটাল লিটারেসি মিশন চালু করতে হবে। যেখানে স্কুল, কলেজ, মসজিদ ও ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার ব্যবহার করে কমিউনিটি পর্যায়ে শেখানো হবে কীভাবে তথ্য খুঁজে বের করা যায়, কীভাবে সরকারি সেবা পাওয়া যায়, কীভাবে অনলাইন ব্যাংকিং, ই-মেইল, বা পেশাদার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করা যায়। পাশাপাশি অনলাইনে যেন যাবতীয় সেবা নির্বিঘ্নে পাওয়া যায় সে ব্যবস্থাও করতে হবে।

 

স্থানীয় অ্যাপ ও কনটেন্ট নির্মাতাদেরও উৎসাহিত করতে হবে। যারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাণিজ্য বা প্রশাসন বিষয়ক অ্যাপ বা কনটেন্ট তৈরি করছে- তাদের জন্য সরকারি অনুদান, প্রণোদনা সুবিধা চালু করতে হবে। একই সঙ্গে সরকারি সেবাগুলোকে একটি একক ব্যবহারবান্ধব অ্যাপে সংযুক্ত করে সাধারণ মানুষের নাগালে আনতে হবে। মোবাইল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে প্রতি নতুন ফোনে অ্যাপটি ইনস্টল করে দিতে হবে।

 

এক দেশ, এক অ্যাপ হবে- যাতে জন্ম নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, শিক্ষার্থীর পড়াশোনা, নানা স্কলারশিপ, অনলাইন ভিত্তিক স্কিল ট্রেনিং, ব্যবসায়ীর ট্যাক্স প্রদান, বিদ্যুৎ ফি জমা দেওয়া, জমিজমার খাজনা, সরকারি সেবা, হাসপাতালে বুকিং সব সহজেই করা যাবে।

 

জনপ্রিয় ইউটিউবার ও অনলাইন ইনফ্লুয়েন্সারদের মাধ্যমে ইন্টারনেটের গঠনমূলক ব্যবহারের গল্প ছড়িয়ে দিতে হবে। এদের মাধ্যমে মানুষকে দেখাতে হবে, ইন্টারনেট মানে শুধু ফেসবুক নয়- এটি হতে পারে আপনার আয়ের উৎস, শেখার প্ল্যাটফর্ম, অথবা সামাজিক পরিবর্তনের হাতিয়ার।

 

আমাদের প্রতি নাগরিকের একটি কার্যকর ইউনিক ডিজিটাল আইডি, ই-পেমেন্ট সিস্টেম এবং নিরাপদ অনলাইন পরিসর গড়ে তুলতে হবে। যাতে ইউনিক আইডি ব্যবহার করে যাবতীয় সেবা নেওয়া যায়, ই-পেমেন্টের মাধ্যমে অনলাইনে পেমেন্ট করা যায় এবং নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য যেন নিরাপদ থাকে। এই তিনটি ব্যবস্থা যদি কার্যকরভাবে গড়ে তোলা যায়, তাহলে মানুষ ইন্টারনেট-ভিত্তিক সেবার প্রতি আস্থা পাবে। সরকার ও বেসরকারি খাতের যৌথ উদ্ভাবন ও অংশীদারিত্ব সহজ হবে।

 

আমাদের আশেপাশেই অনেকে রয়েছে আগে শুধু বিনোদনের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার করলেও বর্তমানে ফ্রিল্যান্সিং অর্থাৎ ডিজিটাল মার্কেটিং, গ্রাফিক্স ডিজাইন, অনলাইনে ব্যবসায়িক প্লাটফর্ম করে আয় করছে। অনেকে ফাইভার আপওয়ার্কে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছেন। অনেক ফার্ম হয়েছে, প্লাটফর্ম হয়েছে যারা শুধু অনলাইনে বিদেশী ক্লায়েন্টের কাজ করেন।

 

একটি প্রযুক্তিনির্ভর নয়; জনগণকেন্দ্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ইন্টারনেট বাস্তবতা গড়ার মাধ্যমে আমাদের ডিজিটাল পরিসরে উত্তরণ ঘটাতে হবে। এখানে তরুণরা শুধু স্ক্রল করে সময় নষ্ট করবে না, বরং নিজেদের উন্নয়নে, পরিবারের স্বনির্ভরতায় এবং দেশের অগ্রগতিতে অবদান রাখবে। ফেসবুকই যদি সব হয় তবে আমরা কেবল ভোক্তা বৈ কিছুই হব না। কিন্তু ইন্টারনেটের পুরো সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে আমরা হব নির্মাতা, অংশীদার এবং আমাদের নিজস্ব ডিজিটাল ভবিষ্যতের রূপকার।

লেখক : চেয়ারম্যান, কনস্টিলেশন অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড।

সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ‘আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধে প্রধান উপদেষ্টাকে বার বার পত্র দিয়েছে বিএনপি’

» রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে আ. লীগকে নিষিদ্ধ করলে ভালো হতো : জামায়াত আমির

» গাজায় মৃত্যু ঝুঁকিতে ৬৫ হাজার শিশু

» ব্যক্তি বা সত্তার কার্যক্রম নিষিদ্ধের বিধান যুক্ত করে সন্ত্রাসবিরোধী অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন

» জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ছোঁয়া ক্রীড়াঙ্গনেও লেগেছিল : যুব ও ক্রীড়া উ পদেষ্টা

» ফেসবুক-ইউটিউব-গণমাধ্যমে আওয়ামী লীগের প্রচারণা নিষিদ্ধ

» ওয়ানশুটার গান ও দেশীয় অস্ত্রসহ তিনজন আটক

» রাজনৈতিক দলের বিচারে ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধন করে গেজেট প্রকাশ

» নিজের আকিকা করা যাবে?

» যুবককে কুপিয়ে হত্যা

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

ইন্টারনেটের ব্যবহার শুধু বিনোদনে নয়, বদল হোক উৎপাদনশীলতায়

ছবি সংগৃহীত

 

তানভীর আলী :বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর ৬০ শতাংশ তরুণ, যারা প্রতিনিয়ত নতুন প্রযুক্তির সংস্পর্শে থাকে। তাদের বাইরে শহর থেকে গ্রামে জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশ বর্তমানে ডিজিটালি সংযুক্ত। সবার হাতে স্মার্টফোন রয়েছে। অধিকাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। ফলে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা নিয়ে আমরা এখন গর্ব করতে পারি। তবে আমাদের সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, স্মার্টফোন কিংবা ডিজিটাল ডিভাইসগুলোর মাধ্যমে ইন্টারনেট জগতে বিচরণকে আমরা বিনোদনের প্লাটফর্ম বাদে অন্য কিছু ভাবতে পারি না।

 

প্রায় ৯০ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ‘ইন্টারনেট’ বলতে শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্লাটফর্ম- ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক ইত্যাদি বোঝেন। এটি আমাদের ডিজিটাল ভবিষ্যতের জন্য এক বিপজ্জনক সংকেত। একটি একক বাণিজ্যিক প্ল্যাটফর্মে আমাদের যাবতীয় সামাজিক যোগাযোগ, তথ্যপ্রাপ্তি, এমনকি নাগরিক ভাবনাও বন্দী হয়ে পড়েছে। ইন্টারনেট কিংবা মোবাইলের ব্যবহারকে আমরা আরো প্রোডাক্টিভ করতে পারছি না।

এটা ঠিক সামগ্রিকভাবে দেশের নানা ইস্যু, সরকারের জবাবদিহিতার জায়গা ফেসবুকে তৈরি হয়েছে। নাগরিকরা সহজে মতামত দিতে পারেন। তার পাশাপাশি ফেসবুক-টিকটক প্ল্যাটফর্ম-কেন্দ্রিক বাস্তবতা আমাদের বৃহত্তর ডিজিটাল সম্ভাবনাকে সীমিত করে রেখেছে। নাগরিকদের অনেকেই জানেন না কীভাবে সরকারি ই-সেবা নিতে হয়, কীভাবে গুগলে কার্যকরভাবে তথ্য খোঁজা যায়, বা কীভাবে অনলাইন ব্যাংকিং, ফ্রিল্যান্সিং বা উদ্যোক্তা কার্যক্রমে যুক্ত হওয়া যায়। বস্তুত আমাদের একটি প্রযুক্তিনির্ভর জনগোষ্ঠী গড়ে উঠলেও তারা প্রকৃত অর্থে ডিজিটাল নাগরিক হয়ে উঠতে পারেনি। ফেসবুক, ইউটিউব বা টিকটকের বাইরে ইন্টারনেটের বিশাল দুনিয়া যেন অচেনা ও অধরা থেকে যাচ্ছে।

 

রক্ষণশীল পরিবারগুলোতে মোবাইল ফোনের ব্যবহারকে এখনও নেতিবাচকভাবে দেখা হয়। এটার কারণ হলো- ফোন ব্যবহার করে উৎপাদনশীল কিছু করা যায় এটা আমরা ভাবতে পারি না। আমাদের এই অবস্থানের বদল না ঘটলে প্রযুক্তিতে আগামীর বাংলাদেশের সম্ভাবনা হবে শুধু একটি অ্যাপনির্ভর বাস্তবতা। এখানে ব্যবহারকারীরা জানে শুধু কীভাবে ‘স্ক্রল’ করতে হয়।

 

আমাদের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকেও এটাকে ফ্যাসিলিটেড করা হয়েছে। সিম কোম্পানিগুলো ফেসবুককে জিরো-রেটিং করেছে অর্থাৎ ডেটা ছাড়াই ফেসবুক ব্যবহার করা যায়। এরসঙ্গে ফেসবুকের সহজ ইন্টারফেস ও পরিচিত পরিবেশ কোটি মানুষকে অনলাইন জগতে এনেছে। কিন্তু বাকি ওয়েব জগতকে অদৃশ্য করে ফেলেছি। যদি শিক্ষামূলক, স্কিল সম্পর্কিত ওয়েবসাইটগুলোকে জিরো-রেটেড করা না যায়, তাহলে মানুষ বিনোদনের প্ল্যাটফর্মেই আটকে থাকবে। এতে ইন্টারনেট ব্যবহারের বৈচিত্র্য কমে এবং ডিজিটাল নাগরিকের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।

 

সামাজিক মাধ্যমগুলোতে কন্টেন্ট ক্রিয়েশন, অনলাইনে ব্যবসা, ডেলিভারি সেবা, পাঠদান, আইটি স্কিল এগুলোর প্রচার-প্রসার হচ্ছে। এরফলে ব্যবহারকারীরা বিশেষত কিশোর তরুণ প্রজন্ম শিখতে পারছে। সম্ভাবনাময়ী অনলাইন বিজনেস প্লাটফর্ম দাঁড়িয়েছে। তবে গ্রাহক পর্যায়ে ডিজিটাল লিটারেসির অভাব-যার পরিবর্তন হচ্ছে না। উচ্চমানের কনটেন্ট নেই, স্থানীয় প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মগুলোর সবল উপস্থিতি নেই। ফলে যথাযথ ব্যবহার আমরা নিশ্চিত করতে পারছি না।

 

তবে আমি মনে করি, প্রচুর সম্ভাবনা এখনও রয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ প্রযুক্তি গ্রহণে অত্যন্ত আগ্রহী। গ্রামের কৃষক থেকে শুরু করে শহরের কলেজছাত্রী-স্মার্টফোনের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছেন অনলাইনে। এই প্রবণতা প্রমাণ করে, মানুষ প্রস্তুত। প্রয়োজন শুধু সঠিক দিকনির্দেশনা, সহায়ক অবকাঠামো এবং ভবিষ্যৎমুখী নীতিগত সহায়তা।

 

আমাদের প্রথম কাজ হওয়া উচিত, শুধু ফেসবুক নয়-স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সরকারি সেবা এবং স্থানীয় প্ল্যাটফর্মগুলোতেও জিরো-রেটেড সুবিধা প্রদান করা। মানুষকে দেখাতে হবে, ইন্টারনেট শুধু বিনোদনের জায়গা নয়-এটি হতে পারে জীবনের সমস্যা সমাধানের কার্যকর মাধ্যম।

 

পাশাপাশি, জাতীয় পর্যায়ে একটি ডিজিটাল লিটারেসি মিশন চালু করতে হবে। যেখানে স্কুল, কলেজ, মসজিদ ও ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার ব্যবহার করে কমিউনিটি পর্যায়ে শেখানো হবে কীভাবে তথ্য খুঁজে বের করা যায়, কীভাবে সরকারি সেবা পাওয়া যায়, কীভাবে অনলাইন ব্যাংকিং, ই-মেইল, বা পেশাদার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করা যায়। পাশাপাশি অনলাইনে যেন যাবতীয় সেবা নির্বিঘ্নে পাওয়া যায় সে ব্যবস্থাও করতে হবে।

 

স্থানীয় অ্যাপ ও কনটেন্ট নির্মাতাদেরও উৎসাহিত করতে হবে। যারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাণিজ্য বা প্রশাসন বিষয়ক অ্যাপ বা কনটেন্ট তৈরি করছে- তাদের জন্য সরকারি অনুদান, প্রণোদনা সুবিধা চালু করতে হবে। একই সঙ্গে সরকারি সেবাগুলোকে একটি একক ব্যবহারবান্ধব অ্যাপে সংযুক্ত করে সাধারণ মানুষের নাগালে আনতে হবে। মোবাইল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে প্রতি নতুন ফোনে অ্যাপটি ইনস্টল করে দিতে হবে।

 

এক দেশ, এক অ্যাপ হবে- যাতে জন্ম নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, শিক্ষার্থীর পড়াশোনা, নানা স্কলারশিপ, অনলাইন ভিত্তিক স্কিল ট্রেনিং, ব্যবসায়ীর ট্যাক্স প্রদান, বিদ্যুৎ ফি জমা দেওয়া, জমিজমার খাজনা, সরকারি সেবা, হাসপাতালে বুকিং সব সহজেই করা যাবে।

 

জনপ্রিয় ইউটিউবার ও অনলাইন ইনফ্লুয়েন্সারদের মাধ্যমে ইন্টারনেটের গঠনমূলক ব্যবহারের গল্প ছড়িয়ে দিতে হবে। এদের মাধ্যমে মানুষকে দেখাতে হবে, ইন্টারনেট মানে শুধু ফেসবুক নয়- এটি হতে পারে আপনার আয়ের উৎস, শেখার প্ল্যাটফর্ম, অথবা সামাজিক পরিবর্তনের হাতিয়ার।

 

আমাদের প্রতি নাগরিকের একটি কার্যকর ইউনিক ডিজিটাল আইডি, ই-পেমেন্ট সিস্টেম এবং নিরাপদ অনলাইন পরিসর গড়ে তুলতে হবে। যাতে ইউনিক আইডি ব্যবহার করে যাবতীয় সেবা নেওয়া যায়, ই-পেমেন্টের মাধ্যমে অনলাইনে পেমেন্ট করা যায় এবং নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য যেন নিরাপদ থাকে। এই তিনটি ব্যবস্থা যদি কার্যকরভাবে গড়ে তোলা যায়, তাহলে মানুষ ইন্টারনেট-ভিত্তিক সেবার প্রতি আস্থা পাবে। সরকার ও বেসরকারি খাতের যৌথ উদ্ভাবন ও অংশীদারিত্ব সহজ হবে।

 

আমাদের আশেপাশেই অনেকে রয়েছে আগে শুধু বিনোদনের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার করলেও বর্তমানে ফ্রিল্যান্সিং অর্থাৎ ডিজিটাল মার্কেটিং, গ্রাফিক্স ডিজাইন, অনলাইনে ব্যবসায়িক প্লাটফর্ম করে আয় করছে। অনেকে ফাইভার আপওয়ার্কে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছেন। অনেক ফার্ম হয়েছে, প্লাটফর্ম হয়েছে যারা শুধু অনলাইনে বিদেশী ক্লায়েন্টের কাজ করেন।

 

একটি প্রযুক্তিনির্ভর নয়; জনগণকেন্দ্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ইন্টারনেট বাস্তবতা গড়ার মাধ্যমে আমাদের ডিজিটাল পরিসরে উত্তরণ ঘটাতে হবে। এখানে তরুণরা শুধু স্ক্রল করে সময় নষ্ট করবে না, বরং নিজেদের উন্নয়নে, পরিবারের স্বনির্ভরতায় এবং দেশের অগ্রগতিতে অবদান রাখবে। ফেসবুকই যদি সব হয় তবে আমরা কেবল ভোক্তা বৈ কিছুই হব না। কিন্তু ইন্টারনেটের পুরো সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে আমরা হব নির্মাতা, অংশীদার এবং আমাদের নিজস্ব ডিজিটাল ভবিষ্যতের রূপকার।

লেখক : চেয়ারম্যান, কনস্টিলেশন অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড।

সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com